Astrology Journeys

Horoscope reading, Prediction, Palm reading, Numerology, Gem Stone, Mantras, Reiki, Meditation & astrology article,রাশিফল, জন্ম ছক বিশ্লেষণ, রত্ন, মন্ত্র,রেইকি, ধ্যান।

Breaking

সোমবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

What is meditation ? How to meditate ? ধ্যান কি? কিভাবে ধ্যান করবেন ?

ধ্যানের ভূমি

What is meditation? How to meditate? https://www.astrologyjourneys.com/?m=1

প্রাথমিক অন্ধকারময় ভূমি

ধ্যানের ভূমি থেকে ধ্যানের অন্তিম লক্ষ্য সম্পূর্ণ বিপরীত। ধ্যান আমরা অন্ধকারে বা চোখ বুজে করি। এই অন্ধকার হল আলো দেখার জন্য,এই চোখবোজা হল দুচোখ ভরে আনন্দকে প্রত্যক্ষ করব বলে। তমসাচ্ছন্ন ক্লেদময় পঙ্ক যদি হয় ধ্যানের ভূমি, তবে আকাশময় আলোকময় দ্যুলোক হইল ধ্যানের নিজস্ব ভূমি। অন্ধকারের পারাপারে যে দিব্য জ্যোতি তাই আমাদের ধ্যানের লক্ষ। চোখ বুজে ধ্যান করা হয় এই কারণে যাতে অন্তর চক্ষুর উন্মোচন হয়।

ধ্যান একা একা করা হয়, চিরকাল একা থাকার জন্য নয়-নিজেকে বিশ্বের সব কিছুতে দেখার জন্য, বিশ্বের সব কিছু 'আমির'মধ্যে এসে মিলিত হয়েছে; এই সত্যকে প্রত্যক্ষ করার জন্য। একলাকেই নিয়ে চিরকাল থাকবো এটি ধ্যানের লক্ষ্য নয়। ধ্যানের লক্ষ্য হইল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে নিয়ে।

অপার আনন্দের মধ্যে ভবিষ্যতে ছড়িয়ে পড়ার জন্য প্রথমে বিষাদময় হাসিখুশি ধ্যানের ভূমি। ধ্যান হইতেই অপার অনাবিল আনন্দের উদ্ভব হয়। ধ্যানের প্রাপ্তি হইল পরম পরিতৃপ্তি, শান্তি ও আনন্দ। ধ্যান করতে করতেই বোঝা যায় ধ্যানের মজা বা রসটা কোথায়? সেই রস হইল দিব্য প্রসাদ যা ধ্যানের মাধ্যমেই প্রাপ্ত হয়।

ধ্যানের প্রভাবে আমরা বস্তুর স্বরূপটি সহজেই ধরতে পারি। ধ্যানের প্রভাবে আমরা বিভ্রান্ত হই কম। ধ্যানের প্রভাবে সত্য দর্শন করিয়া আমরা এই জগতটাকে অস্বীকার করিনা, লীলারূপে মজা দেখি মাত্র। যক্ষা রোগ হইলে জ্বর, কাশি, ক্ষুধামান্দ্য, রক্তবমি ইত্যাদি হয়।কিন্তু যক্ষার ক্ষেত্রে উপসর্গ রোগগুলির চিকিৎসা না করিয়া মূলরোগ যক্ষার চিকিৎসা করতে হয়।মূলরোগের চিকিৎসা করিলে অচিরেই উপসর্গ রোগগুলির উপশম হয়। মূলের চিকিৎসা করতে গেলে স্বচ্ছদৃষ্টি, অন্তর্দৃষ্টি প্রয়োজন। ধ্যান সেই অন্তর্দৃষ্টি যোগায়।

ধ্যানের মধ্য দিয়ে পরমেশ্বরকে খুব শক্ত করে ধরতে হয়, তা না হইলে সংসারের আবর্তে আমরা দিশেহারা, বিহ্বল, ছন্নছাড়া, বিপর্যস্ত এবং পরিশেষে বিলুপ্ত হতে বসি। ধ্যানের মধ্য দিয়ে আমরা সাক্ষাৎ স্বর্গলোকে আরোহন করি। এই দেহের মধ্যেই স্বর্গ, মর্ত, পাতাল বিরাজ করে। ভ্রুমধ্যে এবং তার উপরিভাগে যখন মন বিচরণ করে তখন আমরা স্বর্গলোকে অবস্থান করি। মন তখন দিব্য অনুভূতিসমূহ লাভ করে এবং পরম আনন্দে বিরাজ করে। মন যখন নিচের দিকে যেতে চায়, তখন তাকে চেষ্টা করিয়া ধ্যানযোগে উপর দিকে তুলতে হয়। এটিই হলো ধ্যানের তপস্যা বা সাধনা।

আলোকময় ভূমি

এটি মনের স্বাভাবিক ভূমি। ধ্যানের প্রভাবেই আমরা সেই দিব্য ভূমিতে আরোহন করতে সমর্থ হই। ধ্যানের মধ্য দিয়ে আমরা আত্মার সাক্ষাৎকার লাভ করি-দেহ, মন, ইন্দ্রিয়, প্রাণ-এর কবল থেকে মুক্ত হয়ে আমরা আত্মার দিব্য আনন্দময় নিত্য-শুদ্ধ লোকে বিরাজ করি।

মন যখন চঞ্চল হয় তখনই লক্ষ্য করতে হয় যে দেহের কোন অংশে মন বিরাজ করছে; তার স্বাভাবিক অবস্থিতিকে শনাক্ত করতে হয়।মনের অবস্থানকে শনাক্ত করিয়া তাকে ধীরে ধীরে বক্ষে ও কন্ঠের মর্তলোকে তুলতে চেষ্টা করিতে হয়। তারপর তাকে ভ্রুমধ্যে বা সহস্রারে আনতে হয়, সেখানে স্বর্গলোকের অনাবিল আনন্দ সদা বিদ্যমান। মনরূপ লোহাকে মস্তিষ্কের সহস্রারের বিরাট চুম্বক খনির সঙ্গে ধ্যানযোগে বিলগ্ন করিয়া রাখিলে, মনের আর পড়বার ভয় থাকে না।সর্বদা অনুভব করিতে চেষ্টা করতে হয় মস্তিষ্কের সেই বিরাট চুম্বকখনি প্রতিষ্ঠিত। তিনিই পরমেশ্বর-যিনি জীবজগৎকে আকর্ষণ করিয়া ধরিয়া রেখেছেন। তারই উপস্থিতি জগৎসংসারকে শৃঙ্খলাময়, সামঞ্জস্যপূর্ণ  ও ছন্দময় করিয়া তুলেছেন।

ধ্যানের মধ্য দিয়ে যাকে লাভ করি তিনি কিন্তু পৃথিবীর কোটি ধন-সম্পদ-ঐশ্বর্য-প্রতিষ্ঠা-প্রতিপত্তির বিকল্প; অর্থাৎ তাকে পেতে হবে নতুবা সবকিছুতে মজে থাকতে হবে। ধ্যানের দ্বারা প্রকৃত সত্যের অনুশীলন করতে হয়।প্রকৃত সত্য একদিন সাধকের জীবনে প্রত্যক্ষ হয়ে ফুটে ওঠেন। ধ্যানের মধ্য দিয়ে আমরা আত্মানুভূতির দিব্য আনন্দ লাভ করি। এই অনুভূতি আমাদের সত্তাকে একেবারে চুম্বকের মতন টেনে নেয়। ধ্যান মানে মনকে তার নিজ নিকেতনে অধিষ্ঠিত করা। মনের স্বাভাবিক ভূমি হইল চিন্তাহীন অবস্থা। ধ্যানের  মধ্যে মন গুটিয়ে থার্মোমিটারের পারার মন্ডের মধ্যে প্রবেশের মতন,  ভ্রুমধ্যে নিজ সিংহাসনে রাজবেশে দিব্য অধিষ্ঠান করেন। মনের ইহা হইল স্বাভাবিক বিশ্রামস্থল।

ধ্যানের সপ্তভূমি

ধানের সপ্তভূমি হইল-পাতাল, জগৎব্রহ্মাণ্ড, সূক্ষ্ম ভূমি, কারণ ভূমি, আদ্যা শক্তি ও সত্য লোক। ধ্যানের মধ্য দিয়ে 6টি লোক ভেদ করিয়া আমরা অন্তিমে পরম সত্যলোকে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সাতটি লোক হইল জগত ব্রম্ভান্ডের যাবতীয় সাতটি স্তর বা পর্যায়। ধানের অন্তিম লক্ষ্য হলো পরম দিব্য অখণ্ড সপ্ত ভূমি।

দেহের মধ্যে যোগীরা এই সপ্ত ভূমিকে সপ্ত চক্র রূপে দর্শন করেন।
  1. মূলাধার-জড় পদার্থের পুঞ্জিভূত তমসাবৃত মূর্তি।
  2. সাধিষ্ঠান-যেখানে জড়পদার্থের তমসা, রজঃ-এর সঙ্গে মিলেছে। অন্ধকার যথেষ্ট, তবে কিছুটা পাতলা হয়েছে।
  3. মনিপুর-যেখানে আলোর সূচনা কিছুটা ঘটেছে।
  4. অনাহত-যেখানে সবকিছু সত্তা সমষ্টি রূপে বিরাজমান।
  5. বিশুদ্ধ-সৃষ্টির অগ্রবর্তী সংবেগ।
  6. আজ্ঞাচক্র-সৃষ্টির প্রারম্ভিক সূচনা, যেখানে আলো, তেজ মহাবিস্ফোরণের প্রারম্ভিক অবস্থা।
  7. সহস্রার-সত্যলোক।

অবাধিত দৃষ্টি 

ধ্যানের এই ভূমি থেকে বিশ্বজগৎটাকে কি রকম দেখায়?ধ্যানী যে দৃষ্টি নিয়ে জগৎ ব্রহ্মাণ্ডের দিকে দিকপাত করেন তারই নাম অখন্ডদৃষ্টি। পর্বত শৃঙ্গ থেকে নিচের দিকে তাকালে যেমন সবকিছু একনজরে দেখা যায় অথবা নীচ থেকে খোলা আকাশের পানে চোখ মেলে দিলে যেমন গ্রহ-নক্ষত্র, নীহারিকাপুঞ্জসমেত সবকিছু আবার আমাদের দৃষ্টিপাতে আসে তেমনটি হলো এই অখণ্ডদৃষ্টি।

ধ্যানের মধ্য দিয়ে মেধাবীগন সেই সমুজ্জল মূর্তি ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করেন। তার তিনটি শর্ত। প্রথম শর্ত-মেধা, দ্বিতীয় শর্ত-বিশেষ প্রয়াস অর্থাৎ জপ, ধ্যান  ইত্যাদি, তৃতীয় শর্ত-সদা জাগ্রত ভাব অর্থাৎ সর্বদা সচেতন থাকা-মোহ অলসতা তন্দ্রা সর্বতোভাবে বর্জন। বস্তুত ধ্যান মানে সদা জাগরুক অবস্থা; নিরন্তর যিনি জেগে আছেন তিনি ধ্যানী। নিরন্তর যিনি জেগে থাকেন, পরমেশ্বর তার নিকট সহজেই ধরা দেন। আমাকে নিদ্রিত অচেতন তন্দ্রাতুর দেখলে তিনি আমার দুয়ার গোড়া হতে ফিরে চলে যান।

আমার সত্তাটি তাতে সংলগ্ন রাখাই হইল আসল কাজ। যতোটুকু সেটি সম্ভব হচ্ছে ততটুকু শান্তি পরিতৃপ্তি ও অনাবিল আনন্দ। যেই তাতে ব্যাঘাত ঘটে তখনই যন্ত্রণার উদ্ভব। সন্তান মহানন্দে মাতৃস্তন পান করছে; সরিয়ে নিলেই কান্না জুড়ে দেয়, আবার মাতৃবক্ষের স্পর্শ পেলে ঠান্ডা হয়। মৌমাছিরা ফুলের উপর ধ্যানস্থ হয়ে মধু পান করে-নিরবে পরম পরিতৃপ্তি সহকারে; সেই প্রবাহে যখন ছেদ পড়ে তখনই চঞ্চলতা ও গুনগুন শব্দ।

বিশ্বসংসারে আমরা যতক্ষণ না পরমেশ্বরের মধুময় স্পর্শ লাভ করছি, ততক্ষন আমাদের জীবন যন্ত্রণা থেকে রেহাই নেই। যন্ত্রণার রকমফের হইতে পারে, কিন্তু পরিত্রান কিছুতেই পাওয়া যায় না। ধ্যান আমাদের ক্ষণিকের তরে হলেও সেই দিব্যলোকে নিয়ে যায় এবং আমাদের প্রত্যক্ষভাবে পরমেশ্বরীও সঙ্গের আস্বাদন ঘটায়। আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি, আমাদের আসল ঘর কোনটি, আমাদের স্বরূপটি কি, আমাদের দিব্য আশ্রয় কোনটি।

মুলটিকে শক্ত করে ধরতে পারলে সংসার-জটের ভেল্কিবাজির প্রকোপ আমাদের নিকট থেকে অনেকটাই তিরোহিত হয়। খেলার আনন্দ, অভিনয়ের আনন্দ, স্বপ্নের আনন্দ নিয়ে জগত ব্যাপারের সুখদুঃখ হাসি-কান্না ইত্যাদি সবকিছু তটস্থ হয়ে প্রত্যক্ষ করা যায়। সুখের মধ্যেও আমরা আমাদের হারিয়ে ফেলি না, দুঃখের মধ্যেও আমরা একেবারে মুষড়ে পড়ি না। আমাদের আত্মানন্দ সর্বদাই ধ্যানযোগে অবিঘ্নিত থাকে। ঋতু পরিবর্তনের মতন সুযোগ দুর্যোগ আসে যায়-কিন্তু তা আমাদের আসলে স্পর্শ করতে পারে না। এই আস্বাদনের সুযোগ, এই কর্মকৌশল আয়ত্ত করাই হলো ধ্যানের সবচেয়ে বড় মাহাত্ম্য। ঈশ্বরীয় এই মহাপ্রসাদ আমরা এই ধ্যানযোগে জীবনে লাভ করে থাকি।

আকাশ পানে চোখ মেলে দিলে দৃষ্টি অপ্রতিহত গতিতে অনন্তের পানে ছুটে চলে, আকাশময় ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের দৃষ্টি তখন গ্রহ-নক্ষত্র, নীহারিকাপুঞ্জ ইত্যাদিকে প্রত্যক্ষ করে। ক্ষুদ্রতর এই চোখ দুটি দিয়ে আমি স্থূলভাবে যখন এতটা প্রত্যক্ষ করি, তখন অন্তর চক্ষুর এক ঝলকে আমরা ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করতে পারব না কেন? যিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অধিপতি হয়েও বিশ্বময় পরিব্যাপ্ত রয়েছেন, যিনি বিশ্বসৃষ্টি করেও ক্ষান্ত হননি, বিশ্বের ক্ষুদ্র বৃহৎ সবকিছুর মধ্যে পরিব্যাপ্ত হয়ে বিরাজ করছেন, তিনি হলেন পরমেশ্বর।

ধ্যানযোগে মানুষ ঈশ্বরের এই পরমপদ সর্বদাই প্রত্যক্ষ করেন। কখনোই সেই দিব্য পরমপদ তাদের দৃষ্টির অগোচর হয় না। অর্থাৎ কখনোই সেই ঈশ্বরীয় ধ্যান ভাব থেকে ক্ষণিকের তরেও চ্যুত হন না। জাগতিক সর্ব কর্ম তারা হয়তো করিয়া চলেন, কিন্তু তাদের ভিতর ধ্যান প্রবাহ সর্বদাই পরমেশ্বরের প্রতি প্রবাহিত হয়ে চলেছে। শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেবের ভাষায় কচ্ছপ জলে ডাঙ্গায় চড়ে বেড়ায়, কিন্তু তার মন পড়ে থাকে আড়ায়, যেখানে তার ডিম গুলি আছে অর্থাৎ কচ্ছপ তার ডিমের ধ্যান করে চলেছে।

ধ্যান দৃষ্টির যে বৈশিষ্ট্য ঋকবেদে প্রকট হয়েছে, সেটি হইল অখন্ডদৃষ্টি, অবারিত দৃষ্টি, পরিচ্ছন্ন দৃষ্টি-এক লহমায় সবকিছু দেখা-বিশ্বভুবনটাকে একদৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করা। কাঁচের মধ্য দিয়ে মানুষ যেমন সবকিছু দেখতে পায়, ধ্যান তেমন দৃষ্টিকে বাধিত হতে দেয় না। এক, দুই, তিন ইত্যাদি পর্যায়ক্রমে দেখা নয়, একেবারে সবকিছু দেখা। আলোক ঝলকের মতন এ সমগ্র ক্ষেত্রকে নিমেষে উদ্ভাসিত সমুজ্জ্বল করিয়া তোলে, একটু একটু বা পর্যায়ক্রমে নয়-ক্রমরোহিতভাবে। ধ্যান দৃষ্টি হইল এই ক্রমরোহিত দৃষ্টি। বই আমরা প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় পৃষ্ঠা-এইভাবে পড়ি; নাটক আমরা প্রথম দৃশ্য, দ্বিতীয় দৃশ্য-এইভাবে দেখি। ধ্যানপ্রসূত অখন্ড দৃষ্টি এরকম নয়। ধ্যানের প্রভাবে ধ্যানী সমগ্র বইটাকে যেন একখানা খোলা পাতা বই এর মতন অথবা একটি পঠিত পুস্তক হিসাবে মনে করেন। একটি তিন ঘন্টার চলচ্চিত্রকে নিমেষে তিনি প্রত্যক্ষ করেন। অভিজ্ঞ চিকিৎসক অনেক সময় একনজরে রোগীর রোগ নির্ণয় করেন অথচ তার অনুচরেরা বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই সেই একই সিদ্ধান্তে অনেক শ্রম ও সময় অন্তে উপনীত হন। ধ্যান দৃষ্টিতে গোটা জগত ব্রহ্মাণ্ডের সবকিছু  নিমিষে দেখা, বোঝা, আস্বাদন করা হয়ে যায়।সুতরাং  আর দেখার পাওয়ার বাকি কিছু থাকেনা।

আমিতো নিরন্তর পরমেশ্বরকেই সবকিছুর মধ্যে সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষ করছি, সুতরাং জগত চলচ্চিত্রের কোন অংশটি আমায় আকর্ষণ করতে পারে বা ধরে রাখতে পারে? তবুও মহাপুরুষরা যেন স্বেচ্ছায় খেলাটা চালিয়ে যান, যতক্ষণ না তাদের দেহটা স্বাভাবিকভাবে বিলীন হয়ে যায়। সেই মহাপুরুষরা আমাদের দৃষ্টান্ত। আমাদের তাদের মতন অখন্ড দৃষ্টি সম্পন্ন হতে সচেষ্ট হতে হবে।

আবৃত্তচক্ষু

ধ্যানীর চক্ষু হইল এই আবৃত্তচক্ষু।আবৃত্তচক্ষু মানে যে চক্ষুগোলকটি ঘুরে যায় অর্থাৎ নয়নতারাটি ভিতর দিকে ঢুকে যায়। পাখিদের চক্ষু আবৃত্তচক্ষু, মাছের চক্ষু আবৃত্তচক্ষু। প্রসঙ্গত মাছের চোখের পর্দা নেই, তারা গোলকটি ঘুরিয়েই নিদ্রা যায়, সেটি তাদের ক্ষেত্রে পর্দার কাজ করে। ধ্যানী চক্ষুগোলকটি ইষৎ উপরে তুলে ধ্যান করেন, দৃষ্টি তার নিম্নলোক থেকে ঊর্ধ্বলোকে।

ইন্দ্রিয় আমাদের বহির্মুখী করতে চাইছে, ধ্যানী ধ্যান প্রভাবে মনসমেত সেই ইন্দ্রিয়াদিকে অন্তর্মুখী করেন। বিষয় থেকে প্রতিনিবৃত্ত হয়ে যার মন নিহত আত্মা অভিমুখী হয়, তিনি হলেন যথার্থ ধ্যানী, তিনি যথার্থ আবৃত্তচক্ষু। শুধু চোখ উল্টে বসে রইলেই তাকে আবৃত্তচক্ষু বলা হয় না। যিনি ধ্যান করেন, তিনি চলতে ফিরতে সর্বদাই ধ্যান নিয়ত। তার চোখের সামনে নানান বিষয়ে এসে হাজির হয়।সাধারণ মানুষ তাতেই প্রমত্ত এবং বিলগ্ন হয়ে পড়ে। ধ্যানীর চোখ সেগুলির দিকে দিকপাতমাত্র ঘুরে যায়, মনটিকে তিনি ক্ষণিকের জন্যও ওইভাবে বিষয়ে লিপ্ত হতে দেন না, স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ায় তার চক্ষু, মন এবং অন্তরটি বিষয় থেকে সরে গিয়ে পরমেশ্বরে বিলগ্ন হয়।

ধ্যানী চোখ উল্টে পথ দিয়ে চলেন না।তা করলে তিনি তো গাড়ি চাপা পড়বেন অথবা অনুরূপ দুর্ঘটনা ঘটবে। আসলে চোখ তার বাইরের বিষয় ব্যাহত দেখছে বটে, কিন্তু অন্তরে সেই বিষয়কে তিনি প্রবেশ করতে দিচ্ছেন না অথবা তা তার অন্তরে বিন্দুমাত্র দাগ কাটতে পারেনা। বাইরের কোন কিছু বিষয় তার ধ্যান ভঙ্গ ঘটাতে সমর্থ হয় না। যারা প্রবর্তক সাধক তাদের পক্ষে অবশ্য চর্মচক্ষু এবং অন্তরচক্ষু উভয়কেই ঘুরিয়ে নিয়ে আবৃত্তচক্ষু হতে হয়। ইন্দ্রিয় বিষয়ের সঙ্গে ইন্দ্রিয় সংযোগ হওয়ামাত্রই তিনি ইন্দ্রিয়কে গুটিয়ে নেবেন-যেমন কচ্ছপ হস্তপদাদি নিমেষে ভেতরে গুটিয়ে নেয়।অখন্ডদৃষ্টি লাভের একটি আবশ্যিক পূর্বশর্ত হইলো আবৃত্তচক্ষু হওয়া। যার চোখ আবর্তিত হয় না, একটি বিষয়ে আকৃষ্ট হয়ে লেগে যায়, তার আর আবৃত্তচক্ষু বা ধ্যান সাধক হওয়া সম্ভব হয় না।

শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেবের কথামৃত অনুসারে-পাখি ডিমে তা দিচ্ছে, ফ্যালফ্যালে দৃষ্টি নিয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে আছে, পনেরো আনা মন তার ডিমে তা দেওয়ার দিকে পড়ে আছে, বাকি এক আনা দিয়ে সে জগত সংসার দেখছে। ধ্যানীও সেরকম পনেরো আনা মন-প্রয়াস ঈশ্বরে সমর্পণ করিয়া চলেন, বাকি এক আনা কর্মপ্রয়াস দিয়ে জগৎ সংসার এ কাজ করেন, চলাফেরা করেন। তার দৃষ্টি ফ্যালফ্যালে অর্থাৎ ভাসা-ভাসা অগভীর-এই বিশ্বজগতের কোন কিছুতেই তার মন বা আগ্রহ নেই। তিনি যেন তাঁর সমগ্র মনপ্রাণ সত্তাকে পরমেশ্বরের শ্রীপাদপদ্মে সংলগ্ন করিয়া রেখেছেন। ফ্যালফ্যালে মানে বাহ্য বিষয় দৃষ্টি নিতান্তই অগভীর, কিন্তু ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গে তা অত্যন্ত সুগভীর।

এই দিব্যচক্ষু আর কিছুই নয়-শুদ্ধ ধ্যানদৃষ্টি। ধ্যানের মধ্য দিয়ে আমরা আসল সত্যের আভাস পেয়ে থাকি। ধ্যানদৃষ্টি দিয়েই তার ক্রিয়াশীলতা আমরা ধরতে পারি, ধ্যানের মধ্যে তার অস্তিত্ব আমরা অনুভব করতে পারি। ধ্যান দৃষ্টিতে সহজেই জগতব্রম্ভান্ডের নশ্বরতা ও ভঙ্গুরতা অতি সহজেই ধরা পড়ে।

ধ্যানের মাধ্যমে আমাদের সত্যদৃষ্টি লাভের অধিকার জন্মায়, সত্য প্রতিষ্ঠা ঘটায়। আমরা মহামোহের অসারতা এবং কারচুপি সহজেই ধরতে পারি এবং সেই ফাঁদে পা দিতে যাই না। ধ্যানদৃষ্টির প্রভাবে আমরা মহামায়ার লীলা দেখে তা উপভোগ করি।

নীরবে-নিভৃতে সবকিছুর মধ্যে তার রূপ, তাঁর বাণী, তার স্পর্শ, তার সঙ্গ অনুভব করবার জন্য উদগ্রীব হও। তার সেই দিব্যলীলা প্রত্যক্ষ করবার মধ্যে দিয়ে জন্মকর্ম সার্থক, মহিমময় অখন্ড করিয়া তোল। নিজে হাত বাড়াবার আগে তার হাতটি প্রসারিত হয়েছে, এটি অনুভব করতে চেষ্টা করো ধ্যানদৃষ্টিতে। ধ্যানযোগে তাকে খণ্ড-খণ্ড ক্ষেত্রে পেতে পেতে পরিশেষে খন্ডসত্তা তার আখন্ড সত্তায় ধ্যানসমাধিযোগে বিলীন হয়। সৃষ্টি অখন্ড হয়, খন্ডিত ধ্যান অখন্ড সমাধিতে পর্যবসিত হয়।

সত্যদৃষ্টি

অনন্ত চক্রপ্রবাহের নামই জগৎ-সংসার যা নিরন্তর চলছে এবং সরে সরে যাচ্ছে। আখেরি বিবর্তনে এত দ্বৈততা এত বৈচিত্র্য-এই মূল দিব্য সত্যটি আমরা কেবলমাত্র ধ্যান প্রভাবেই প্রত্যক্ষ করতে পারি।এই ধ্যান প্রভাবেই সুখের সময় আমরা আত্মহারা হই না, দুঃখের সময় আমরা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ি না। সুখও যেমন থাকে না, দুঃখও তেমন থাকে না-থাকে শুধু আত্মচৈতন্য। তিনি নিরন্তর নিরবিচ্ছিন্নভাবে ক্রমবিবর্তিত হচ্ছেন-এই সত্যটিকে শক্ত করে ধরা হলো জগৎসংসারের এই তুফানে নোঙ্গর করে দাঁড়ানো।

কাল হলো আখন্ড, অথচ আমরা সেটাকে বৎসর, মাস, সপ্তাহ, দিন, ঘন্টা, মিনিট ইত্যাদিতে ভাগ করি। সত্যটি হল, কাল অখন্ড অথচ ব্যবহারিক ক্ষেত্রে আমরা দেখি এবং পাই কাল যেন খন্ড খন্ড। স্থানের ক্ষেত্রেও তাই। সমগ্র ক্ষেত্রমন্ডল অখন্ড। ধ্যানের মধ্য দিয়ে অতি সহজেই আমরা অনন্ত অখন্ড সত্তার সঙ্গে সংযুক্ত সমন্বিত ও সমাহিত হতে পারি। আমাদের খন্ড সত্তা অখণ্ড সত্তায় পর্যবসিত হয়। স্থান-কাল-পাত্রের বিভাজন বিলুপ্ত হয়, বোধহয় আমি অনন্তকাল ধরে এই অখণ্ড সত্তা, এই অখণ্ড মহাকাশাধারে বিরাজ করছি। ধ্যান ব্যতীত অন্য কোন পার্থিব  উপায়ে এত সহজে সেই আখন্ড সত্তার প্রত্যক্ষ স্পর্শ বা সংযোগ আমরা অনুভব করতে পারি না।ইন্টারনেটের সাহায্যে আমরা যেমন পৃথিবীর যেকোন প্রান্তের সঙ্গে নিমেষে সংযোগ স্থাপন করি, ধ্যানরূপি সুপার ইন্টারনেটের সাহায্যে আমরা সহস্রকোটি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে অনন্তকালব্যাপী সংযুক্ত হতে পারি।

এই ধ্যানদৃষ্টিই হইল যথার্থ বিজ্ঞানদৃষ্টি। মেঘের স্তর ভেদ করে এই সত্য দৃষ্টিই আমাদের বস্তুর স্বরূপ ও সত্যমূর্তি প্রত্যক্ষ করায়। তার জন্যই অন্ধকার,কুয়াশা ইত্যাদি যা-কিছু আপাত তা ধ্যানীবিজ্ঞানীকে বিভ্রান্ত করতে পারেনা। সত্যকে জানা ও চেনাই হলো ধ্যান। মিথ্যাটি সেই ধ্যানজ্ঞানেরই প্রভাবে আপনি প্রতিহত ও প্রতিরুদ্ধ হয়ে যায় অথবা কোনরূপ বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। জড়বিজ্ঞানীও সত্যসন্ধানী এবং ধ্যানীও সত্যসন্ধানী। জড়বিজ্ঞান খন্ড সত্তাকে  ধরে এগোয়, ধ্যানী অখণ্ড সত্তাকে ধরে এগোতে চেষ্টা করেন। জড়বিজ্ঞান যেখানে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়, ধ্যানবিজ্ঞান সেখানে অখন্ড বোধকে সম্বল করে যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা প্রতিহত করে প্রত্যয়ভরে এগিয়ে যায়।







1 টি মন্তব্য:

  1. ইশা ধ্যান যোগ কেন্দ্রে যোগাযগের জন্য আপনাদের কাছে কোন সহযোগিতা পেতে পারি।

    উত্তরমুছুন